ভারতের জাতীয় সঙ্গীত
জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে ভারতের জাতীয় সংগীত। এই গানটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্তৃক তৎসম বাংলা ভাষায় রচিত। গানটির রচনাকাল জানা যায় না। ১ নজর ৯১১ সালে জাতীয় কংগ্রেসের একটি সভায় এটি প্রথম গীত হয়। ১৯৫০ সালে স্বাধীন ভারতের জাতীয় সঙ্গীত রূপে স্বীকৃতি লাভ করে এর প্রথম স্তবকটি। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত বন্দেমাতরমগানটিও সমমর্যাদায় জাতীয় সঙ্গীতের স্বীকৃতি লাভ করে। বর্তমানে জনগণমন ভারতের জাতীয় স্তোত্র বা রাষ্ট্রগান (ন্যাশানাল অ্যানথেম) ও বন্দেমাতরমভারতের জাতীয় সঙ্গীত বা রাষ্ট্রগীত (ন্যাশানাল সং) বিবেচিত হয়।
জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে ইমন রাগে কাহারবা তালে নিবদ্ধ। দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর এর স্বরলিপিকার। স্বরবিতান ১৬-এ এর স্বরলিপি মুদ্রিত। ভারত সরকারঅনুমোদিত স্বরলিপিটি বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ প্রকাশিত রাষ্ট্রসংগীত গ্রন্থে মুদ্রিত।
পাঠ
জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে রবীন্দ্রনাথের গীতবিতান সংগীত-সংকলনের স্বদেশ পর্যায়ভুক্ত ১৪ সংখ্যক গান। কবির সঞ্চয়িতা কাব্য-সংকলনে এই গানের কথা ভারত-বিধাতা শিরোনামে মুদ্রিত। মোট পাঁচটি স্তবকের মধ্যে প্রথম স্তবকটিই জাতীয় সংগীতরূপে গীত হয়। গানের সম্পূর্ণ পাঠটি এইরূপ[১]:
জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে ভারতভাগ্যবিধাতা!
পঞ্জাব সিন্ধু গুজরাট মরাঠা দ্রাবিড় উৎকল বঙ্গ
বিন্ধ্য হিমাচল যমুনা গঙ্গা উচ্ছলজলধিতরঙ্গ
তব শুভ নামে জাগে, তব শুভ আশিষ মাগে,
গাহে তব জয়গাথা।
জনগণমঙ্গলদায়ক জয় হে ভারতভাগ্যবিধাতা!
জয় হে, জয় হে, জয় হে, জয় জয় জয় জয় হে।।
অহরহ তব আহ্বান প্রচারিত, শুনি তব উদার বাণী
হিন্দু বৌদ্ধ শিখ জৈন পারসিক মুসলমান খৃস্টানী
পূরব পশ্চিম আসে তব সিংহাসন-পাশে
প্রেমহার হয় গাঁথা।
জনগণ-ঐক্য-বিধায়ক জয় হে ভারতভাগ্যবিধাতা!
জয় হে, জয় হে, জয় হে, জয় জয় জয় জয় হে।।
পতন-অভ্যুদয়-বন্ধুর পন্থা, যুগ যুগ ধাবিত যাত্রী।
হে চিরসারথি, তব রথচক্রে মুখরিত পথ দিনরাত্রি।
দারুণ বিপ্লব-মাঝে তব শঙ্খধ্বনি বাজে
সঙ্কটদুঃখত্রাতা।
জনগণপথপরিচায়ক জয় হে ভারতভাগ্যবিধাতা!
জয় হে, জয় হে, জয় হে, জয় জয় জয় জয় হে।।
ঘোরতিমিরঘন নিবিড় নিশীথে পীড়িত মূর্ছিত দেশে
জাগ্রত ছিল তব অবিচল মঙ্গল নতনয়নে অনিমেষে।
দুঃস্বপ্নে আতঙ্কে রক্ষা করিলে অঙ্কে
স্নেহময়ী তুমি মাতা।
জনগণদুঃখত্রায়ক জয় হে ভারতভাগ্যবিধাতা!
জয় হে, জয় হে, জয় হে, জয় জয় জয় জয় হে।।
রাত্রি প্রভাতিল, উদিল রবিচ্ছবি পূর্ব-উদয়গিরিভালে –
গাহে বিহঙ্গম, পূণ্য সমীরণ নবজীবনরস ঢালে।
তব করুণারুণরাগে নিদ্রিত ভারত জাগে
তব চরণে নত মাথা।
জয় জয় জয় হে জয় রাজেশ্বর ভারতভাগ্যবিধাতা!
জয় হে, জয় হে, জয় হে, জয় জয় জয় জয় হে।।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
পঞ্জাব সিন্ধু গুজরাট মরাঠা দ্রাবিড় উৎকল বঙ্গ
বিন্ধ্য হিমাচল যমুনা গঙ্গা উচ্ছলজলধিতরঙ্গ
তব শুভ নামে জাগে, তব শুভ আশিষ মাগে,
গাহে তব জয়গাথা।
জনগণমঙ্গলদায়ক জয় হে ভারতভাগ্যবিধাতা!
জয় হে, জয় হে, জয় হে, জয় জয় জয় জয় হে।।
অহরহ তব আহ্বান প্রচারিত, শুনি তব উদার বাণী
হিন্দু বৌদ্ধ শিখ জৈন পারসিক মুসলমান খৃস্টানী
পূরব পশ্চিম আসে তব সিংহাসন-পাশে
প্রেমহার হয় গাঁথা।
জনগণ-ঐক্য-বিধায়ক জয় হে ভারতভাগ্যবিধাতা!
জয় হে, জয় হে, জয় হে, জয় জয় জয় জয় হে।।
পতন-অভ্যুদয়-বন্ধুর পন্থা, যুগ যুগ ধাবিত যাত্রী।
হে চিরসারথি, তব রথচক্রে মুখরিত পথ দিনরাত্রি।
দারুণ বিপ্লব-মাঝে তব শঙ্খধ্বনি বাজে
সঙ্কটদুঃখত্রাতা।
জনগণপথপরিচায়ক জয় হে ভারতভাগ্যবিধাতা!
জয় হে, জয় হে, জয় হে, জয় জয় জয় জয় হে।।
ঘোরতিমিরঘন নিবিড় নিশীথে পীড়িত মূর্ছিত দেশে
জাগ্রত ছিল তব অবিচল মঙ্গল নতনয়নে অনিমেষে।
দুঃস্বপ্নে আতঙ্কে রক্ষা করিলে অঙ্কে
স্নেহময়ী তুমি মাতা।
জনগণদুঃখত্রায়ক জয় হে ভারতভাগ্যবিধাতা!
জয় হে, জয় হে, জয় হে, জয় জয় জয় জয় হে।।
রাত্রি প্রভাতিল, উদিল রবিচ্ছবি পূর্ব-উদয়গিরিভালে –
গাহে বিহঙ্গম, পূণ্য সমীরণ নবজীবনরস ঢালে।
তব করুণারুণরাগে নিদ্রিত ভারত জাগে
তব চরণে নত মাথা।
জয় জয় জয় হে জয় রাজেশ্বর ভারতভাগ্যবিধাতা!
জয় হে, জয় হে, জয় হে, জয় জয় জয় জয় হে।।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ইতিহাস
জনগণমন সঙ্গীতের কোনও পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায়নি। সেই কারণে এই গানটি কোথায় কবে রচিত হয়েছিল তা নিশ্চিত জানা যায় না। গানটি প্রথম গীত হয় ২৭ ডিসেম্বর, ১৯১১ তারিখের মধ্যে কলকাতায়আয়োজিত ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের ২৬তম বার্ষিক অধিবেশনে। গানটি গাওয়া হয়েছিল সমবেতকণ্ঠে। দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেতৃত্বে গানের রিহার্সাল হয়েছিল ডক্টর নীলরতন সরকারেরহ্যারিসন রোডস্থ (বর্তমানে মহাত্মা গান্ধী রোড) বাসভবনে। পরদিন দ্য বেঙ্গলি পত্রিকায় গানটির ইংরেজি অনুবাদসহ এই সংবাদের প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। আদি ব্রাহ্মসমাজের মুখপত্র তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার মাঘ ১৩১৮ সংখ্যা অর্থাৎ জানুয়ারি ১৯১২ সংখ্যায় ভারত-বিধাতা শিরোনামে প্রকাশিত এই গানটি ব্রহ্মসঙ্গীত আখ্যায় প্রচারিত হয়েছিল। সেই বছর মাঘোৎসবেও গানটি গীত হয়।[২]
অধুনা অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্যের মদনপল্লী নামক স্থানে রবীন্দ্রনাথ জনগণমন-এর ইংরেজি অনুবাদ করেন। ১৯১১ সালে প্রথম প্রকাশিত হলে এই গানটি রবীন্দ্রনাথ-সম্পাদিত তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার পাতাতেই রয়ে যায়। ১৯১৮-১৯ সালে বেসান্ত থিওজফিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ জেমস এইচ কাজিনস রবীন্দ্রনাথকে সেখানে কয়েকদিন অতিবাহিত করার আমন্ত্রণ জানান। কাজিনস ছিলেন আইরিশ ভাষার এক বিতর্কিত কবি ও রবীন্দ্রনাথের বিশিষ্ট বন্ধু। ২৮ ফেব্রুয়ারি একটি ছাত্র সম্মেলনে তিনি কাজিনস-এর অনুরোধে বাংলাইয় গানটি গেয়ে শোনান। তার কয়েকদিন পরে, মদনপল্লীর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ কবি গানটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেন এবং পাশ্চাত্য সঙ্গীত বিশেষজ্ঞা কাজিনস-পত্নী মার্গারেট গানটির স্বরলিপি রচনা করেন। এই স্বরলিপিটি আজও অনুসরণ করা হয়ে থাকে।[৩][৪]
মদনপল্লীর বেসান্ত থিওজফিক্যাল কলেজের লাইব্রেরিতে আজও সেই মূল ইংরেজি অনুবাদটি ফ্রেমবদ্ধ আকারে প্রদর্শিত হয়।[৫]
১৯৩০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সোভিয়েত ইউনিয়নভ্রমণকালে মস্কোয় পায়োনিয়ার্স কমিউনের অনাথ বালক-বালিকারা রবীন্দ্রনাথকে একটি গান গাইতে অনুরোধ করলে, তিনি তাদের জনগণমন গেয়ে শোনান। [৬]
১৯৩৭ সালেই জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে প্রথম জনগণমন গানটির নাম প্রস্তাব করেন সুভাষচন্দ্র বসু। ১৯৪৩ সালের ৫ জুলাই আজাদ হিন্দ ফৌজগঠনের কথা ঘোষণা করা হয় এবং সেই দিনই প্রথম জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে জনগণমন গাওয়া হয়। এরপর ওই বছরের ২৫ অগস্ট নেতাজি আনুষ্ঠানিকভাবে আজাদ হিন্দ ফৌজের সেনাপতির পদ গ্রহণ করেন ও ২১ অক্টোবর সিঙ্গাপুরে আরজি হুকুমৎ-এ-হিন্দ প্রতিষ্ঠা করেন। এই দিনও জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে জনগণমন গাওয়া হয়েছিল। নেতাজি আজাদ হিন্দ সরকারের সেক্রেটারি আনন্দমোহন সহায়ের উপর দায়িত্ব দেন গানটির হিন্দুস্থানীঅনুবাদের জন্য। তিনি লয়ালপুরের তরুণ কবি হুসেনের সাহায্যে কাজটি সম্পাদন করেন। অনুবাদের সময় মূল গানের সামান্য পরিবর্তন সাধিত হলেও তার ভাব ও সুর অক্ষুন্ন থাকে। পরবর্তীকালে আনন্দমোহন সহায়ের লেখা থেকে জানা যায়, এই গান সেই সময় ভারত ও ভারতের বাইরেও বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল এবং জাপান ও জার্মানির বিদ্যান সমাজ এই গান শুনে অভিভূত হয়েছিলেন। ১৯৪৪ সালের মার্চ মাসে আজাদ হিন্দ ফৌজ মৌডক রণক্ষেত্রে জয়লাভ করে ভারতের মাটিতে প্রবেশ করে ও সেই দিনই প্রথম ভারতের মাটিতে জনগণমন ভারতের জাতীয় সঙ্গীত রূপে বাজানো হয়। [৭]
জাতীয় সঙ্গীতের স্বীকৃতিলাভ
ভারতের স্বাধীনতার প্রাক্কালে কোনও জাতীয় সঙ্গীত নির্বাচিত হয়নি। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে জাতিসংঘে ভারতীয় প্রতিনিধিদলের কাছে কোনও এক অনুষ্ঠানে বাজানোর জন্য ভারতের জাতীয় সঙ্গীতের একটি রেকর্ড চাওয়া হলে, তাঁরা তৎক্ষণাৎ ভারত সরকারকে বিষয়টি অবহিত করেন ও জনগণমন বাজানোর পক্ষে মত প্রকাশ করেন। সরকারের অনুমোদনক্রমে জাতিসংঘের অর্কেস্ট্রাবাদনের একটি গ্রামোফোন রেকর্ড সেই অনুষ্ঠানে সাফল্যের সাথে বাজানো হয়। জওহরলাল নেহেরু পরে বলেছিলেন, এই গানের সুর সেদিন সবার দ্বারা প্রশংসিত হয় এবং বিভিন্ন রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা এই সুরটির স্বাতন্ত্র্য ও আভিজাত্যে মুগ্ধ হয়ে এর স্বরলিপি চেয়ে পাঠান। [১০]
পরবর্তীকালে ‘গায়নযোগ্যতা’ বা ‘singability’-এর কারণে বন্দেমাতরম-এর বদলে জনগণমন-কেই ভারতের জাতীয় সঙ্গীত করার পক্ষে বিশেষজ্ঞরা মতপ্রকাশ করেন। একই সাথে ভারতের মুসলমান সমাজের কাছেও এই গানটির গ্রহণযোগ্যতা ছিল। বন্দেমাতরম-এ দেশকে হিন্দু দেবীর আদলে বন্দনা করায় সেই গানটি তাঁদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। অবশেষে ২৪ জানুয়ারি ১৯৫০ তারিখে ভারতের সংবিধান সভা এই গানটিকে জাতীয় সংগীত বা ন্যাশানাল অ্যানথেম হিসাবে গ্রহণ করেন। সভাপতি ডক্টর রাজেন্দ্র প্রসাদ বলেন, “জনগণমন নামে পরিচিত গানটি কথা ও সুরসহ ভারতের জাতীয় সংগীতরূপে সরকারিভাবে গীত হবে। কোনও নির্দিষ্ট কারণ উপস্থিত হলে সরকার এই গানের কথায় যে কোনও রকম পরিবর্তন আনতে পারবেন। বন্দেমাতরম গানটি যেহেতু ভারতের জাতীয় সংগ্রামে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্থানের অধিকারী, সেই হেতু এটিও জনগণমন-এর সমমর্যাদাসম্পন্ন হবে।” [১১]
ব্যবহার
জাতীয় সঙ্গীতের বাদন বিষয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর কিছু স্পষ্ট নির্দেশনামা আছে।
- জাতীয় অভিবাদনকালে – ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের সাংবিধানিক প্রধান রাষ্ট্রপতি ও রাজ্যগুলির সাংবিধানিক প্রধান রাজ্যপাল এবং বিভিন্ন বিদেশি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধানদের (অনুষ্ঠানবিশেষে) জাতীয় অভিবাদন জানানোর সময় জাতীয় সঙ্গীত বাজানো হয়। ১৯৫০ সালের জানুয়ারি মাস থেকে রাজকীয় অভিবাদনের বদলে জাতীয় অভিবাদন জানানোর সময় থেকেই এই প্রথা চলে আসছে। বিদেশি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধানদের জাতীয় অভিবাদন জানানোর সময় প্রথমে সেই দেশের জাতীয় সঙ্গীত বাজানো হয় এবং পরে ভারতের জাতীয় সঙ্গীত বাজানো হয়। এখানে মনে রাখা দরকার, এই নির্দিষ্ট কয়েকজন পদাধিকারী ভিন্ন দেশে ছাড়া কারও অভিবাদন জাতীয় সঙ্গীত দ্বারা হয় না। তবে কয়েকটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীকে জাতীয় সঙ্গীত দ্বারা অভিবাদন জানানো হয়ে থাকে।
- জাতীয় পতাকা উত্তোলনকালে – প্রতি বছর স্বাধীনতা দিবস ও সাধারণতন্ত্র দিবস জাতীয় পতাকা উত্তোলনকালে জাতীয় সঙ্গীত বাজানো হয়।
এছাড়াও কয়েকটি ক্ষেত্রে জাতীয় সঙ্গীত ব্যবহৃত হয়ে থাকে। যেমন, সেনাবাহিনীতে লয়্যাল টোস্ট প্রদানের সময়, নৌবাহিনীর পতাকা উত্তোলনের সময়, কুচকাওয়াজে প্রত্যয়নের উদ্দেশ্যে জাতীয় পতাকা আনীত হলে ইত্যাদি।
অন্যান্য সরকারি বিভাগ ও সাধারণ ব্যবহারের ক্ষেত্রেও এই নিয়ম প্রযোজ্য। জাতীয় সঙ্গীত ৫২ সেকেন্ডে গাওয়া হয় অথবা সংক্ষেপণের ক্ষেত্রে ২০ সেকেন্ডে এর প্রথম ও শেষ পঙক্তি গাওয়া হয়ে থাকে। কিন্তু এক মিনিটের অধিক সময় ধরে এই গান গাওয়া যায় না।
জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার সময় উঠে দাঁড়ানো কর্তব্য। পূর্বে সিনেমা হলে সিনেমা শেষ হওয়ার পর জাতীয় সঙ্গীত বাজানোর প্রথা ছিল। বর্তমানে এই প্রথা অবলুপ্ত।
বিতর্ক
স্বাধীন ভারতের জাতীয় সঙ্গীত ঘোষিত হওয়ার পর জনগণমন-কে ঘিরে কিছু বিতর্ক দানা বাঁধে। প্রকৃতপক্ষে গানটি লেখা হয়েছিল ১৯১১ সালের ডিসেম্বর মাসে রাজা পঞ্চম জর্জের দিল্লি দরবারের কিছুদিন আগে। এই গানটি প্রথম গীত হয়েছিল সেই বছরের ২৭ ডিসেম্বর ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনের দ্বিতীয় দিনে। সেই দিনের এজেন্ডা ছিল রাজা পঞ্চম জর্জকে একটু আনুগত্যমূলক স্বাগত জানানোর প্রস্তাবনা। রাজার সম্মানে সেদিন হিন্দিতে রামভূজ চৌধুরীর একটি গান গাওয়া হয়।[১২] আবার সেই দিনই রবীন্দ্রনাথের মত এক বিশিষ্ট ব্যক্তির গান অনুষ্ঠানে গীত হওয়ায় সংবাদমাধ্যমের ভুলে একটি ভ্রান্ত খবর প্রচারিত হয় যে রবীন্দ্রনাথের গানটিও সম্রাটের প্রতি সম্মানার্থে রচিত হয়েছে। পরদিনের ইংরেজি সংবাদপত্রগুলিতে এই সংবাদ প্রচারিতও হয়ঃ “বাঙালি কবি বাবু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশেষত সম্রাটকে স্বাগত জানিয়ে একটি গান রচনা করেছেন।” [১৩] স্বাভাবিকভাবেই রবীন্দ্রবিরোধীগণ প্রচার করতে থাকেন যে গানটি আসলে সম্রাটের বন্দনাগান। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য এই সংবাদপত্রগুলির একটি কয়েকটি বন্দেমাতরমরবীন্দ্রনাথের রচিত ও জনগণমন-কে হিন্দি গান আখ্যাও দিয়েছিল। [১২]
প্রকৃত ঘটনা জানা যায় ১৯৩৭ সালের ২০ নভেম্বরবিশ্বভারতীর প্রাক্তনী পুলিনবিহারী সেনকে লেখা রবীন্দ্রনাথের একটি চিঠি থেকেঃ
ভারতের জাতীয় সঙ্গীতের ‘সিন্ধু’ শব্দটিকে পরিবর্তিত করে ‘কাশ্মীর’ শব্দটি যোজনা করার দাবি ওঠে ২০০৫ সালে। যাঁরা দাবি তুলেছিলেন, তাঁদের যুক্তি ছিল, ১৯৪৭ সালের ভারতবিভাগের পর সিন্ধু প্রদেশ সম্পূর্ণত পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এই দাবির বিরোধীরা পাল্টা যুক্তি দেন, জাতীয় সংগীতে ‘সিন্ধু’ শব্দটি কেবলমাত্র সিন্ধু প্রদেশ নয়, বরং সিন্ধু নদ ও ভারতীয় সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ সিন্ধি ভাষা ও সংস্কৃতিরও পরিচায়ক। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট এই যুক্তি মেনে জাতীয় সঙ্গীতের ভাষায় কোনরূপ পরিবর্তনের বিপক্ষে মত দেন।
১৯৮৫ সালে কেরল রাজ্যের জিহোবাস উইটনেস-এর কয়েকজন ছাত্র বিদ্যালয়ে জাতীয় সঙ্গীত গাইতে অস্বীকার করলে, তাদের স্কুল থেকে বিতাড়িত করা হয়। একজন অভিভাবক সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হলে, সুপ্রিম কোর্ট কেরল হাইকোর্টের রায় বদলে স্কুল কর্তৃপক্ষকে ছাত্রদের পুনরায় ভর্তি নেওয়ার নির্দেশ দেন। সুপ্রিম কোর্টের সেই ঐতিহাসিক রায়ে বলা হয়েছিল, “আমাদের (ভারতীয়) ঐতিহ্য শেখায় সহিষ্ণুতা, আমাদের দর্শন শেখায় সহিষ্ণুতা, আমাদের সংবিধান শেখায় সহিষ্ণুতা, তাকে আমরা যেন নষ্ট করে না ফেলি।”[১৫]
বিদগ্ধজনের মত
নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু (আরজি হুকুমৎ-এ-হিন্দ-এর নির্দেশনামা)
আনন্দমোহন সহায়, সেক্রেটারি, আরজি হুকুমৎ-এ-হিন্দ
জেমস এইচ কাজিনস
মহাত্মা গান্ধী
জওহরলাল নেহেরু
জনপ্রিয় মাধ্যমে জাতীয় সঙ্গীত
জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে – ইন্ডিয়ান ন্যাশানাল অ্যানথেম শীর্ষক একটি ঐতিহাসিক ভিডিও ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে প্রকাশিত হয়। ২৬ জানুয়ারি ২০০০ তারিখে সংসদ ভবনের সেন্ট্রাল হলে রাষ্ট্রপতি এই ভিডিওর উদ্বোধন করেন। ভারত বালা প্রযোজিত এই ভিডিওর সঙ্গীত পরিচালনা করেন এ আর রহমান এবং প্রকাশ করেন ভারত সরকারের সংস্কৃতি, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রক।
দেশের ৩৫ জন প্রধান শিল্পী এই অ্যালবামে কণ্ঠ বা বাদ্যদান করেছিলেন। কণ্ঠশিল্পীরা ছিলেন এ আর রহমান, ডি কে পট্টমল, পণ্ডিত ভীমসেন জোশী, লতা মঙ্গেশকর, পণ্ডিত যশরাজ, এম বালমূর্তি কৃষ্ণ, জগজিৎ সিং, পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী, শোভনা গুরতু, বেগম পারভিন সুলতানা, ভুপেন হাজারিকা, উস্তাদ রাশিদ খান, উস্তাদ গুলাম মুস্তাফা খান, শ্রীমতি শ্রুতি সাদোলিকর, ডক্টর এস পি বালসুব্রহ্মণ্যম, সুধা রঘুনাথন, আশা ভোঁসলে, হরিহরণ, কবিতা কৃষ্ণমূর্তি, পি উন্নিকৃষ্ণণ, নিত্যশ্রী, সাদিক খান লাঙ্গা, গুলাম মুরতাজা খান, গুলাম কাদির খান ও কৌশিকী চক্রবর্তী। বাঁশিতে ছিলেন পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া, সরোদে উস্তাদ আমজাদ আলি খান, আমান আলি খান ও আয়ান আলি খান, সন্তুরে পণ্ডিত শিবকুমার শর্মা ও রাহুল শর্মা, ঘট্টমে ভিক্কু বিনায়কম ও উমা শংকর, মোহন বীণায় পণ্ডিত বিশ্বমোহন ভট্ট, স্যাক্সোফোনে কাদ্রি গোপালনাথ, চিত্রবীণায় রবিকিরণ, বীণায় ই গায়ত্রী, সারেঙ্গিতে উস্তাদ সুলতান খান, সেতারে পণ্ডিত কার্তিক কুমার ও নীলাদ্রি কুমার এবং ভায়োলিনে ছিলেন কুমারেশ ও গণেশ। চেন্নাইবাসী শিল্পী তোতা তারিণী এই অ্যালবামের লোগো নির্মাণ করেন। সারা দেশে এই অ্যালবাম প্রভূত জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।